۳ آذر ۱۴۰۳ |۲۱ جمادی‌الاول ۱۴۴۶ | Nov 23, 2024
ডক্টর, শিক্ষক বা প্রশিক্ষক
ডক্টর, শিক্ষক বা প্রশিক্ষক

হাওজা / ইংরেজি ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষার। এর অর্থ হলো ‘শিক্ষক’ বা ‘প্রশিক্ষক।

লেখা: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

পর্ব ৪- পিএইচডির সাথে মানুষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কেউ কেউ, অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিএইচডি নিতে গিয়ে ছাগলে পরিণত হতে পারেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাগল শব্দটি এ অঞ্চলে বিবর্তিত হয়ে গেছে। এটি আর ছাগলদের দখলে নেই। ছাগলের মাংস, এমনটি আর বাজারে শোনা যায় না। শোনা যায়— খাসির মাংস, বকরির মাংস। রেস্তোরায় গিয়ে এখন আর কেউ বলে না, আমি ছাগলের মাংস দিয়ে ভাত খাবো। মানুষের একটি অংশ, ছাগল শব্দটিকে নিজেদের করে নিয়েছে। ছাগল শব্দটি শুনলে বা দেখলে, তারাই এখন প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা ভাবে, মনে হয় আমাকে বললো! জবাব দিয়ে আসি!

অপ্রয়োজনীয় পিএইচডি হলো সেগুলো, যেগুলো অর্জনের পেছনে কোনো একাডেমিক কারণ নেই। আছে সামাজিক কারণ। বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডিকে এখন বিবেচনা করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হিশেবে। কেউ হয়তো এমন একটি চাকুরি করছেন, যেখানে পিএইচডির কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু তিনি উতলা হয়েছেন পিএইচডি নেয়ার জন্যে। তার শখ হয়েছে, নামের আগে একটি ‘ডক্টর’ লাগানোর। বাঙালির এমন মনোভাব মূলত তার চারিত্রিক হীনম্মন্যতাকেই প্রকাশ করে। সামাজিক মর্যাদার সাথে যে ‘ডক্টর’ শব্দটির কোনো সম্পর্কই নেই, এটি বুঝতে তারা নারাজ। আমি উপরে ‘ডক্টর’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখিয়েছি যে— ডক্টরেট ডিগ্রি আসলেই কোনো সামাজিক মুকুট নয়। এটি একটি প্রয়োজনীয় একাডেমিক ডিগ্রি।

কিন্তু ছাগলদের কাছে এটি সামাজিক মুকুট! তাদের দাবি, এটি না থাকলে নামটি একটু লম্বা করে বলা যায় না। এটি তাদের শিং! কিছু পরিস্থিতিতে, তারা এ শিং দিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ, এটিকে শিং হিশেবে গ্রহণ করেছে। কোনো বিষয়ে আবুল এবং ডক্টর আবুল, এ দুইজন একই কথা বললে, ডক্টর আবুলের কথাকেই ছাগলসমাজ বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাঙালির কোনো অনুষ্ঠানে, মোহাম্মদ জব্বার ও ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের গুরুত্ব এক নয়। ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের দিকে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

কিছু জব্বার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টেক্কা দেয়ার জন্য পিএইচডি নিচ্ছে! তারা বুঝাতে চাচ্ছে, আমরা তাদের চেয়ে কম কিসে? আমাদেরও ডক্টরেট আছে!

ইদানিং ওয়াজ মাহফিলের বক্তারাও এ যুদ্ধে শামিল হয়েছেন। তারাও দলবেঁধে পিএইচডি নেয়া শুরু করেছেন। তারা টের পেয়েছেন, ‘ডক্টর’ নামক মুকুটটি না থাকলে ফতোয়ার ওজন কমে যাচ্ছে, মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। অনেকে হাসাহাসি করছে। মানুষ ধরে নিয়েছে, মাওলানা আশরাফের চেয়ে ডক্টর মাওলানা আশরাফের কথার দাম বেশি! ডক্টর মাওলানা আশরাফ বানোয়াট হাদিস বললেও সেটি সহিহ! তিনি মিথ্যা গল্প বললেও তা সত্য!

যার পিএইচডি আছে, তিনি একজন বিশেষজ্ঞ, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। এ প্রসঙ্গে ফাইনম্যানকে মনে পড়ছে। ফাইনম্যান বলেছিলেন, পিএইচডির পরও কেউ গর্দভ থাকতে পারে।

কেউ যদি তার ভেতরের গাধাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে পিএইচডির তাতে বাধা দেয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। সভ্যতা যাদের জ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অধিকাংশেরই পিএইচডি নেই। তবে এ কথা এ যুগে খুব একটা খাটবে না। এই মুহুর্তে পৃথিবীতে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের অনেকেরই পিএইচডি আছে। আবার অনেকেরই নেই। এটি একটি কাকতাল মাত্র। তবে বাংলাদেশে যাদের পিএইচডি আছে, তাদের নব্বই ভাগই যে বিশেষজ্ঞ নন, সেটি চারদিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়।

আর পিএইচডির কাজ কাউকে বিশেষজ্ঞ করে তোলা নয়। বিশেষজ্ঞ হওয়াটা এখানে ঐচ্ছিক। পিএইচডি এখন গবেষণা করার একটি প্রশিক্ষণ কোর্স মাত্র। এটি একজন ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দেয়, কীভাবে কোনো বিষয়ে গবেষণা করতে হবে, কীভাবে অন্যের করা কাজকে ঘেঁটে দেখতে হবে, কীভাবে কোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্রাড এবং মাস্টার্স কোর্সেও এ প্রশিক্ষণ কিছুটা দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ছাত্রটির, কোনো বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। গবেষণার বিষয়বস্তু ভালো হলে, পিএইচডি থিসিসে কিছু জ্ঞান উৎপন্নও হয়। বিশেষজ্ঞের সাথে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির কোনো আহামরি সম্পর্ক নেই। যিনি কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করেন নি, তিনিও পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। এ জন্য পিএইচডি থাকা খুব জরুরি নয়। তবে যিনি যে-বিষয়ে গবেষণা করেন, সে-বিষয়ে তার বিশেষজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এটি মাথায় রাখতে হবে।

কিন্তু বাঙালি সমাজ ধরে নিয়েছে, যার পিএচডি আছে তিনি মহাজ্ঞানী। আর যার পিএইচডি নেই তিনি কিছুই জানেন না। ছাগলরা এ সুযোগটিই নিয়েছে। তারা ভুয়া পিএইচডির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে প্রকৃত পিএইচডিধারীর চরিত্রে অভিনয় করছে। সমাজের মানুষ এ মনোভাব না পাল্টালে, পিএইচডির সামাজিক ‘মুকুট’ বেঁচে থাকবে, এবং ছাগলদের মাথায় এ মুকুট বিরাজ করতে থাকবে। পিএইচডি নেবেন শুধু তারা, যাদের পিএইচডি দরকার। যারা গবেষণা করবেন, গবেষণা খাতে ক্যারিয়ার গড়বেন, অন্যদের গবেষণা শেখাবেন, অথবা যাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে পিএইচডি থিসিসে তারা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান উৎপাদন করতে পারবেন, কেবল তারাই যেন পিএইচডি ডিগ্রি নেন। এতে বাঁচবে মানুষের জীবনের অনেক মূল্যবান সময়। এ সময় তারা ব্যয় করবে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুখের পেছনে।

—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

বই: ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’(‘ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি’, পৃষ্ঠা ১৭৫ - ১৮২ থেকে)

تبصرہ ارسال

You are replying to: .